অণু গল্প- আত্মজা

আত্মজা
– জয়তী মিত্র

 

 

আজ রবিবার, তিন্নির কলেজ ছুটি। এমনিতেই ছুটির দিনগুলোতে ঘুম থেকে একটু দেরি করেই ওঠে। কিন্তু আজ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা লুচি আর আলুর দমের গন্ধে আর বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে না পেরে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। বেশির ভাগ রবিবারগুলো তিন্নির পছন্দের জলখাবারই বানাতে হয় তিন্নির মা সুমিতা দেবীকে। তিন্নি মা’কে আদর করে বললো, “আজ আমার লুচি খেতেই ইচ্ছা করছিল মা। তুমি কি করে জানলে আমার মনের কথা?

তিন্নির মা সুমিতা দেবী বললেন,”মায়েরা সন্তানের সব কিছু বোঝে। যেদিন তুই মা হবি সেদিন তুইও বুঝবি।”
তিন্নিকে বুকে জড়িয়ে সুমিতা দেবী বললেন,”আজ তোকে তোর জীবনের একটা চরম সত্য কথা জানাবো মা, আজ তোর সব কিছু জানা দরকার। অনেকবার তোকে সব কথা জানাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ভয় পেয়েছিলাম, যদি তোকে হারিয়ে ফেলি, তাই তোকে নিয়ে তোদের বাড়ি ছেড়ে অনেকদূরে চলে এসেছিলাম আমি আর তোর বাবা। যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না।”

তিন্নি কিছু বুঝতে না পেরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সুমিতা দেবী বলতে শুরু করলেন,”আজ থেকে কুড়ি বছর আগে তোর জন্ম এক বনেদী পরিবারে। তোর মা তোকে জন্ম দিয়েই মারা যান। তোর ঠাকুমা আর তোর বাবা তোকে নিতে অস্বীকার করে। তোর ঠাকুমা বললেন, একে তো হয়েছে মেয়ে তার ওপর জন্মেই মা’কে খেয়েছে এ মেয়েকে কে মানুষ করবে! তার থেকে ওকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আয়। তারপর তোকে তারা অনাথ আশ্রমে পাঠাবার কথা ভাবে। আমি তখন তোদের বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম।
দশ বছর আমার বিয়ে হয়ে গেলেও আমাদের কোনো সন্তান হয় নি। সমাজের কত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করেছি। বাঁজা অপবাদ শুনতে শুনতে আমার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। তাই ভগবান হয়তো আমার কষ্টের কথা শুনেছিল। একটা সন্তান লাভের জন্য কত দেবতার কাছে যে মানত করছি সেটা বলাই বাহুল্য। তাই যখন দেখলাম তোকে আশ্রমে পাঠানোর তোড়জোড় চলছে ঠিক তখন আমি আর তোর এই বাবা তোকে আইনি পদ্ধতিতে দত্তক নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, কি বিচিত্র এই পৃথিবী, কেউ কত সাধনা করেও একটা সন্তান পায় না আর যারা সন্তান পায় তারা অবহেলায় তাকে দূরে সরিয়ে দেয়।।আমার মাতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করলো। তোকে পেয়ে আজ আমি সত্য ধন্য রে। তুই আমার জীবনের মূল্যবান সম্পদ। তুই শুধু আমার, আমার আত্মজা।” মায়ের মুখে তার জীবনের কাহিনী শুনে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো তিন্নি। সুমিতা দেবীও তখন অঝোরে কাঁদছেন।
তিন্নি বললো,”তুমি আমার মা, আমি আর কিছু শুনতে চাই না। তুমি ছিলে তাই আমার জীবনটা এতো সুন্দর হয়েছে। না হলে আজ আমি কোথায় হারিয়ে যেতাম। আমার একটাই পরিচয় আমি তোমাদের মেয়ে, আর তোমরা আমার মা,বাবা। যারা আমাকে জন্মের পর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তাদের কথা নাই বা শুনলাম। তোমাদের মত মা, বাবা আছে বলে আজও পৃথিবীটা সুন্দর আছে।”
-চল মা এবার তুই খাবি চল, তোর বাবা পাড়ার মোড়ের মাথা থেকে গরম জিলিপি এনেছে, তুই যে খুব ভালবাসিস জিলিপি খেতে।
চোখের জল মুছিয়ে মেয়েকে তখন খাওয়াতে লাগলেন সুমিতা দেবী।

Loading

Leave A Comment